
Tuesday, September 25, 2018
লক্ষ্মী দেবীর পাঁচালী
লক্ষ্মী দেবীর পাঁচালীঃ
দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ ।
ধীরে ধীরে বহিছে মলয় বাতাস ।।
বৈকুন্ঠেতে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ণ ।
করিতেছেন কত কথা হইয়া মগন ।।
সৃষ্টিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব কত কথা হয় ।
শুনিয়া আনন্দিত দেবীর হৃদয় ।।
অকস্মাৎ দেবর্ষি নারয়ান নাম স্মরে ।
আসিলেন বীনা হস্তে বৈকুন্ঠ নগরে ।।
প্রনাম করি দেবর্ষি কহেন বচন ।
মর্তে সদাই দুর্ভিক্ষ অনল ভীষন ।।
ঋষি বলে মা তুমি চঞ্চলা মন ।
সর্বদা স্থিত এভবন ও ভবন ।।
অন্নাভাবে মর্তবাসী কষ্ট পেয়ে ভোগে ।
মরিছে অনাহারে কৃশকায় রোগে ।।
ধর্মাধর্ম লোকে সবি ত্যাগ করি দেয় ।
স্ত্রী কন্যা বিক্রি করে ক্ষুধার জ্বালায় ।।
দুর্ভিক্ষে হইলো শেষ মরে মনুষ্যগণ ।
দয়া করি মা তুমি করো নিবারন ।।
নারদের বাক্য শুনি কহেন নারায়নী ।
বিশ্বমাতৃকা আমি জগৎের জননী ।।
কারো প্রতি নাই আমরা ক্রোধানল ।
ভুগিছে মর্তবাসী নিজ নিজ কর্মফল ।।
মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্য বচন ।
মর্তবাসী না মানে এই কথন ।।
নারীর পরমগতি স্বামী ভিন্ন কেবা ।
ভুলেও না করে নারী স্বামী পদসেবা ।।
যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেরায় ।
গুরুজনে অকারনে মন্দ বাক্য কয় ।।
যে নারী সকালে না দেয় ছড়া ।
করি তার সংসার আমি লক্ষ্মীছাড়া ।।
অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে ।
দূর দূর করে বিতারিত করে তারে ।।
গুরুদেবের প্রতি ভক্তি নাহি করে ।
আমি যে থাকি না তাহার ঘরে ।।
এঁয়োতি নারী সিঁদুর না দেয় কপালে ।
মলিন বস্ত্রে যথা ইচ্ছা তথা ঘোরে ।।
নিত্য যে না করে অবগাহন ।
তারে ছাড়ি করি অন্যত্র গমন ।।
তিথি ভেদে নিষিদ্ধ বস্তু যে বা খায় ।
হই না কভু তার ওপর সহায় ।।
যে মনুষ্য ভক্তি ভরে একাদশী না করে।
নাহি হই প্রসন্ন তাহার ওপরে ।।
উচ্চ হাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে ।
ঘোমটা না টানে মস্তক উপরে ।।
গুরুজন দেখি যারা প্রনাম নাহি করে।
সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি জালে ঘরে ।।
এমন নারী যে গৃহেতে করে অবস্থান ।
কভু নাহি পায় তারা লক্ষ্মীর বরদান ।।
কহো নারদ কি দোষ আমার ।
জীব ভোগে কর্মদোষে তাহার ।।
ঋষি বলে মাগো তুমি জগতজননী ।
সন্তান কে করো ক্ষমা হে নারায়নী ।।
মর্তবাসীকে দাও তুমি পুনঃ বরদান ।
দূর করো মা তুমি দুর্ভিক্ষ অনাচার ।।
এত বলি বিদায় লন নারদ মুনি।
চিন্তিত হয়ে হরিকে বলেন নারায়নী ।।
কহে মাতা লক্ষ্মী দেবী প্রভু নারায়নে ।
কিরূপে দুঃখ কষ্ট যাইবে সদা দূরে ।।
লক্ষ্মীর কথা শুনি কহেন জনার্দন ।
শুন দেবী মন দিয়া আমার বচন ।।
তুমি দেবী কমলা ধনের অধিষ্ঠাত্রী ।
তোমার কৃপায় দূর হইবে অনাচ্ছিষ্টি ।।
যে জন গুরুবারে লক্ষ্মীব্রত করে ।
সুখে কাটাবে জীবন তোমার বরে ।।
জীবনান্তে আসিবে যখন তার শমন ।
অবশ্যই করিবে সে বৈকুন্ঠে গমন ।।
যাহো দেবী মর্তে করো নিজ ব্রত প্রচার ।
তোমার আশীষে দূর হইবে মহামার ।।
গমন করেন দেবী শুনি বিষ্ণুর কথা ।
পেঁচক পৃষ্ঠে মর্তে আসেন জগতমাতা ।।
অবন্তী নামক নগরী, ধারে ঘন বন ।
হেথায় আসিয়া দেবী উপস্থিত হন ।।
নগরীতে ছিল বনিক ধনেশ্বর রায় ।
অগাধ ধন- চৌদ্দ কূল যেনো বসি খায় ।।
পত্নী সুমতি, আর ছিল সাত কুমার ।
সংসার ছিল তার মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ।।
যথাকালে ধনেশ্বর করিল স্বর্গ গমন ।
বিধবা হইলো সুমতি, ভাগ্যের লিখন ।।
সর্বদা কলহ করে সপ্ত বধূগণ ।
মারমার কাটকাট হইতো সর্বক্ষণ ।।
এইভাবে পৃথক হইলো সাত কুমার ।
সংসার রচিলো যে যার মতো যাহার ।।
সুখের সংসার হইলো ছারখার ।
লক্ষ্মী দেবী ছাড়িলেন সে সংসার ।।
এই দুঃখে বৃদ্ধা বিধবা করিতে আত্মহনন ।
আইলো একাকী নির্জন বন ।।
সেই বৃদ্ধ আপন মনে রোদোন করে ।
বিধিলিপি কেবা খন্ডাইতে পারে ।।
লক্ষ্মী দেবী শোনেন সেই ক্রন্দন ।
নিমিষে দেবী করিলেন বৃদ্ধা বেশ ধারন ।।
দেবী কহেন কে তুমি কি পরিচয় ।
কোথা হতে আসিলে কহ আমায় ।।
একে একে বুড়ী সব কহিল কথন ।
সোনার সংসার তার হইলো ছিন্নভিন্ন ।।
বুড়ী বলে মাগো অভাগা কপাল আমার ।
আসিয়াছি হেথায় আত্মহত্যা করিবার ।।
এই শুনি লক্ষ্মী দেবী বৃদ্ধারে কন ।
আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন ।।
যাও তুমি গৃহে ফিরে করো লক্ষ্মীব্রত ।
অবশ্য আসিবে সুখ পূর্বের মতো ।।
গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এঁয়োগন ।
ব্রতের সকল কিছু করিবে আয়োজন ।।
আসন পাতি লক্ষ্মী মূর্তি তাতে বসাইবে ।
আম্রশাখা গোটা ফলে ঘট স্থাপিবে ।।
বিবিধ পুস্প, বিল্ব আর নৈবদ্য সকল ।
দিবে কলা শর্করা আর আতপ তণ্ডুল ।।
একটি করে মুদ্রা রাখিবে লক্ষ্মী ঘটে ।
এক মুষ্টি করি তণ্ডুল দিবে লক্ষ্মী সাথে ।।
আম্রশাখায় সিঁদুর তৈলে করিয়া গোলা ।
চাল বাটি লক্ষ্মী সম্মুখে দিবেক আল্পনা ।।
ধূপ দীপ জ্বালি সম্মুখে রাখিবে ।
আসন পাতি লক্ষ্মী পূজোয় বসিবে ।।
একমনে পূজিবে লক্ষ্মী নারায়ণ ।
পূজাশেষে ব্রতকথা করিবে পঠন ।।
না করিয়ো পূজায় ঘণ্টা বাদন ।
পূজান্তে উলুধ্বনি দিবে এঁয়োগন ।।
অতঃপর মহাপ্রসাদ সকলকে দিবে ।
সিঁদুর লইয়া এঁয়োগণের কপালে পরাইবে ।।
এই মতো যে জন লক্ষ্মী ব্রত করিবে ।
কোনো দুঃখ আর তার নাহি রবে ।।
শুনিয়া বৃদ্ধা কন আনন্দিত মনে ।
কে তুমি কহো পরিচয় দানে ।।
এই শুনি লক্ষ্মী দেবী নিজ মূর্তি ধরে ।
তাহা দেখি বৃদ্ধা কাঁদে হইয়া করজোড়ে ।।
করেছি মা না জেনে অনেক অপরাধ ।
ক্ষমা করি দাও মা কৃপাপ্রসাদ ।।
লক্ষ্মী কহেন যাও তুমি আপন ভবন ।
অবশ্যই পাইবে তুমি সুখ পূর্বের মতোন ।।
এত বলি বিদায় লইলেন দেবী সাগরনন্দিনী ( দেবী লক্ষ্মী রত্নাকর এর কন্যা )।
ঘরে ফিরি আসিলো ধনেশ্বর পত্নী ।।
বধূগণে ডাকি করে ব্রতের প্রচার ।
ধীরে ধীরে আসিলো বৃহস্পতিবার ।।
সপ্ত বধূ গন একত্রে লক্ষ্মী ব্রত করে ।
অনাচার চলি যায় লক্ষ্মীর বরে ।।
ধীরে ধীরে হইলো সুখের ভবন ।
যেমন ছিল পূর্বে আনন্দ মগন ।।
ধীরে ধীরে সাত সংসার এক হয়ে যায় ।
সংসার হইলো সুখের আলয় ।।
এই দেখি এক রমণী পূজা মানত করে ।
স্বামী তার চিররোগী, উপার্জন হীন সংসারে ।।
ভক্তি ভরে সেই নারী লক্ষ্মীরে পূজে ।
দেবী কৃপায় তাঁর সকল দুঃখ ঘোচে ।।
রোগ ছাড়ি স্বামী পুনঃ সুস্থ হইলো ।
এই ভাবে তার সকল দুঃখ ঘুচিলো ।।
আনন্দ দিনে এক সুন্দর পুত্র জন্মিলো ।
লক্ষ্মী কৃপায় ধন জন বৃদ্ধি পাইলো ।।
এই ভাবে লক্ষ্মী ব্রত প্রচারে দেশ দেশান্তরে ।
সকলে শুনি লক্ষ্মী ব্রত করে ।।
তাহা করি সকলের দুঃখ চলি যায় ।
কমলার কৃপা সকলের উপর বর্ষায় ।।
একদিন লক্ষ্মী পূজোয় বসে বামাগণ ।
আসিলো এক বণিক তাঁহাদের সদন ।।
বণিক কহে কোন দেবী কিবা পরিচয় ।
ইহারে করিলে পূজা কি ফল হয় ।।
বামা গন কহে ইনি দেবী নারায়নী ।
ইহার কৃপাতে সুখে বাড়ে ব্রতিনী ।।
গুরুবারে যে জন লক্ষ্মী পূজো করে ।
অবশ্যই পাইবে সুখ লক্ষ্মীর বরে ।।
এই কথা শুনে হাসে বণিক মহাশয় ।
মানিনা এই সত্য তব কথায় ।।
কপালে যদি না থাকে ধনের লিখন ।
কিরূপে দিবে লক্ষ্মী বর- ধন- জন ।।
শুধু শুধু লক্ষ্মী পূজা করি কিবা হয় ।
বৃথা কাটাইতেছো লক্ষ্মীর পূজায় ।।
গর্বে ভরা বাক্য লক্ষ্মী সইতে না পারে ।
ধীরে ধীরে দেবী তাহারে ছাড়ে ।।
ঝড় উঠি ময়ূরপঙ্খি তার জলে ডোবে ।
ধন জন আদি সব গেলো চলি ভোগে ।।
মড়কে রোগে তার ঘর হইলো ছারখার ।
ভিখারী হইয়া বণিক ঘোরে দ্বারে দ্বার ।।
এই ভাবে বহু দেশ ঘোরে সদাগর ।
একদিন আসিলো অবন্তী নগর ।।
সেই স্থানে ব্রত করে যতেক নারীগণে ।
বসি তারা মন দেয় লক্ষ্মীর ভজনে ।।
এই দেখি বণিকের হইলো স্মরণ ।
এই স্থানে দেবীরে করিছে অবমানন ।।
সেই পাপে সব ধ্বংস হইলো তাহার ।
ভূমিতে পড়ি সদাগর কান্দে বারবার ।।
ক্ষমা করি দাও মাগো কহে সদাগর ।
এই স্থানে করেছি অনেক অহঙ্কার ।।
ধনে গর্বে মত্ত হয়ে তোমাকে অবমাননা ।
সেই পাপে পাইলাম মাগো যতেক লাঞ্ছনা ।।
ক্ষুধা জ্বালায় ঘুরি দেশ দেশান্তরে ।
যতেক আত্মীয় গেলা সবে আমায় ছেড়ে ।।
এইভাবে সদাগর লক্ষ্মী স্তব করে ।
লক্ষ্মী দেবী করুণা করিল তাহারে ।।
লক্ষ্মী কৃপায় বণিক সব ফিরি পায় ।
গৃহে ফিরি মন দেয় লক্ষ্মীর পূজায় ।।
লক্ষ্মী কৃপায় সে সব ফিরি আসে।
এই ভাবে ব্রত ছড়িলো দেশে দেশে ।।
সবে মিলি শোনে লক্ষ্মীর ব্রতের কথন ।
লক্ষ্মীরে পূজে আছে যত জন ।।
প্রতি গৃহে গৃহে লক্ষ্মী পূজো হয় ।
জগতজননীর কৃপা সকলের ওপর বর্ষায় ।।
খাদ্য ধন জন বাড়ে লক্ষ্মীর কৃপায় ।
হরি হরি বল সবই তুলি হস্ত দ্বয় ।।
যেই জন ভক্তি ভরে লক্ষ্মীরে পূজিবে ।
অবশ্যই তাহার সকল দুঃখ ঘুচি যাইবে ।।
যে পড়ে ব্রত কথা আর যে করে শ্রবন ।
অবশ্য পাইবে সে লক্ষ্মী নারায়নের চরণ ।।
ব্রত কথা না শুনিও কভু হেলা মনে ।
লক্ষ্মী কৃপায় অবশ্যই বাড়িবে ধনে জনে ।।
জয় জয় ব্রহ্মময়ী, মা নারায়নী ।
তোমার কৃপায় শেষ করিনু পাঁচালী খানি ।।
( সমাপ্ত )

Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment