Tuesday, September 25, 2018

লক্ষ্মী দেবীর পাঁচালী

লক্ষ্মী দেবীর পাঁচালীঃ দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ । ধীরে ধীরে বহিছে মলয় বাতাস ।। বৈকুন্ঠেতে একাসনে লক্ষ্মী নারায়ণ । করিতেছেন কত কথা হইয়া মগন ।। সৃষ্টিতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব কত কথা হয় । শুনিয়া আনন্দিত দেবীর হৃদয় ।। অকস্মাৎ দেবর্ষি নারয়ান নাম স্মরে । আসিলেন বীনা হস্তে বৈকুন্ঠ নগরে ।। প্রনাম করি দেবর্ষি কহেন বচন । মর্তে সদাই দুর্ভিক্ষ অনল ভীষন ।। ঋষি বলে মা তুমি চঞ্চলা মন । সর্বদা স্থিত এভবন ও ভবন ।। অন্নাভাবে মর্তবাসী কষ্ট পেয়ে ভোগে । মরিছে অনাহারে কৃশকায় রোগে ।। ধর্মাধর্ম লোকে সবি ত্যাগ করি দেয় । স্ত্রী কন্যা বিক্রি করে ক্ষুধার জ্বালায় ।। দুর্ভিক্ষে হইলো শেষ মরে মনুষ্যগণ । দয়া করি মা তুমি করো নিবারন ।। নারদের বাক্য শুনি কহেন নারায়নী । বিশ্বমাতৃকা আমি জগৎের জননী ।। কারো প্রতি নাই আমরা ক্রোধানল । ভুগিছে মর্তবাসী নিজ নিজ কর্মফল ।। মহামায়ার স্বরূপে নারী সত্য বচন । মর্তবাসী না মানে এই কথন ।। নারীর পরমগতি স্বামী ভিন্ন কেবা । ভুলেও না করে নারী স্বামী পদসেবা ।। যথায় স্বেচ্ছায় ঘুরিয়া বেরায় । গুরুজনে অকারনে মন্দ বাক্য কয় ।। যে নারী সকালে না দেয় ছড়া । করি তার সংসার আমি লক্ষ্মীছাড়া ।। অতিথি যদি উপস্থিত হয় দ্বারে । দূর দূর করে বিতারিত করে তারে ।। গুরুদেবের প্রতি ভক্তি নাহি করে । আমি যে থাকি না তাহার ঘরে ।। এঁয়োতি নারী সিঁদুর না দেয় কপালে । মলিন বস্ত্রে যথা ইচ্ছা তথা ঘোরে ।। নিত্য যে না করে অবগাহন । তারে ছাড়ি করি অন্যত্র গমন ।। তিথি ভেদে নিষিদ্ধ বস্তু যে বা খায় । হই না কভু তার ওপর সহায় ।। যে মনুষ্য ভক্তি ভরে একাদশী না করে। নাহি হই প্রসন্ন তাহার ওপরে ।। উচ্চ হাসি হাসিয়া যে নারী ঘোরে । ঘোমটা না টানে মস্তক উপরে ।। গুরুজন দেখি যারা প্রনাম নাহি করে। সন্ধ্যাকালে ধূপ দীপ নাহি জালে ঘরে ।। এমন নারী যে গৃহেতে করে অবস্থান । কভু নাহি পায় তারা লক্ষ্মীর বরদান ।। কহো নারদ কি দোষ আমার । জীব ভোগে কর্মদোষে তাহার ।। ঋষি বলে মাগো তুমি জগতজননী । সন্তান কে করো ক্ষমা হে নারায়নী ।। মর্তবাসীকে দাও তুমি পুনঃ বরদান । দূর করো মা তুমি দুর্ভিক্ষ অনাচার ।। এত বলি বিদায় লন নারদ মুনি। চিন্তিত হয়ে হরিকে বলেন নারায়নী ।। কহে মাতা লক্ষ্মী দেবী প্রভু নারায়নে । কিরূপে দুঃখ কষ্ট যাইবে সদা দূরে ।। লক্ষ্মীর কথা শুনি কহেন জনার্দন । শুন দেবী মন দিয়া আমার বচন ।। তুমি দেবী কমলা ধনের অধিষ্ঠাত্রী । তোমার কৃপায় দূর হইবে অনাচ্ছিষ্টি ।। যে জন গুরুবারে লক্ষ্মীব্রত করে । সুখে কাটাবে জীবন তোমার বরে ।। জীবনান্তে আসিবে যখন তার শমন । অবশ্যই করিবে সে বৈকুন্ঠে গমন ।। যাহো দেবী মর্তে করো নিজ ব্রত প্রচার । তোমার আশীষে দূর হইবে মহামার ।। গমন করেন দেবী শুনি বিষ্ণুর কথা । পেঁচক পৃষ্ঠে মর্তে আসেন জগতমাতা ।। অবন্তী নামক নগরী, ধারে ঘন বন । হেথায় আসিয়া দেবী উপস্থিত হন ।। নগরীতে ছিল বনিক ধনেশ্বর রায় । অগাধ ধন- চৌদ্দ কূল যেনো বসি খায় ।। পত্নী সুমতি, আর ছিল সাত কুমার । সংসার ছিল তার মা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ।। যথাকালে ধনেশ্বর করিল স্বর্গ গমন । বিধবা হইলো সুমতি, ভাগ্যের লিখন ।। সর্বদা কলহ করে সপ্ত বধূগণ । মারমার কাটকাট হইতো সর্বক্ষণ ।। এইভাবে পৃথক হইলো সাত কুমার । সংসার রচিলো যে যার মতো যাহার ।। সুখের সংসার হইলো ছারখার । লক্ষ্মী দেবী ছাড়িলেন সে সংসার ।। এই দুঃখে বৃদ্ধা বিধবা করিতে আত্মহনন । আইলো একাকী নির্জন বন ।। সেই বৃদ্ধ আপন মনে রোদোন করে । বিধিলিপি কেবা খন্ডাইতে পারে ।। লক্ষ্মী দেবী শোনেন সেই ক্রন্দন । নিমিষে দেবী করিলেন বৃদ্ধা বেশ ধারন ।। দেবী কহেন কে তুমি কি পরিচয় । কোথা হতে আসিলে কহ আমায় ।। একে একে বুড়ী সব কহিল কথন । সোনার সংসার তার হইলো ছিন্নভিন্ন ।। বুড়ী বলে মাগো অভাগা কপাল আমার । আসিয়াছি হেথায় আত্মহত্যা করিবার ।। এই শুনি লক্ষ্মী দেবী বৃদ্ধারে কন । আত্মহত্যা মহাপাপ নরকে গমন ।। যাও তুমি গৃহে ফিরে করো লক্ষ্মীব্রত । অবশ্য আসিবে সুখ পূর্বের মতো ।। গুরুবারে সন্ধ্যাকালে মিলি এঁয়োগন । ব্রতের সকল কিছু করিবে আয়োজন ।। আসন পাতি লক্ষ্মী মূর্তি তাতে বসাইবে । আম্রশাখা গোটা ফলে ঘট স্থাপিবে ।। বিবিধ পুস্প, বিল্ব আর নৈবদ্য সকল । দিবে কলা শর্করা আর আতপ তণ্ডুল ।। একটি করে মুদ্রা রাখিবে লক্ষ্মী ঘটে । এক মুষ্টি করি তণ্ডুল দিবে লক্ষ্মী সাথে ।। আম্রশাখায় সিঁদুর তৈলে করিয়া গোলা । চাল বাটি লক্ষ্মী সম্মুখে দিবেক আল্পনা ।। ধূপ দীপ জ্বালি সম্মুখে রাখিবে । আসন পাতি লক্ষ্মী পূজোয় বসিবে ।। একমনে পূজিবে লক্ষ্মী নারায়ণ । পূজাশেষে ব্রতকথা করিবে পঠন ।। না করিয়ো পূজায় ঘণ্টা বাদন । পূজান্তে উলুধ্বনি দিবে এঁয়োগন ।। অতঃপর মহাপ্রসাদ সকলকে দিবে । সিঁদুর লইয়া এঁয়োগণের কপালে পরাইবে ।। এই মতো যে জন লক্ষ্মী ব্রত করিবে । কোনো দুঃখ আর তার নাহি রবে ।। শুনিয়া বৃদ্ধা কন আনন্দিত মনে । কে তুমি কহো পরিচয় দানে ।। এই শুনি লক্ষ্মী দেবী নিজ মূর্তি ধরে । তাহা দেখি বৃদ্ধা কাঁদে হইয়া করজোড়ে ।। করেছি মা না জেনে অনেক অপরাধ । ক্ষমা করি দাও মা কৃপাপ্রসাদ ।। লক্ষ্মী কহেন যাও তুমি আপন ভবন । অবশ্যই পাইবে তুমি সুখ পূর্বের মতোন ।। এত বলি বিদায় লইলেন দেবী সাগরনন্দিনী ( দেবী লক্ষ্মী রত্নাকর এর কন্যা )। ঘরে ফিরি আসিলো ধনেশ্বর পত্নী ।। বধূগণে ডাকি করে ব্রতের প্রচার । ধীরে ধীরে আসিলো বৃহস্পতিবার ।। সপ্ত বধূ গন একত্রে লক্ষ্মী ব্রত করে । অনাচার চলি যায় লক্ষ্মীর বরে ।। ধীরে ধীরে হইলো সুখের ভবন । যেমন ছিল পূর্বে আনন্দ মগন ।। ধীরে ধীরে সাত সংসার এক হয়ে যায় । সংসার হইলো সুখের আলয় ।। এই দেখি এক রমণী পূজা মানত করে । স্বামী তার চিররোগী, উপার্জন হীন সংসারে ।। ভক্তি ভরে সেই নারী লক্ষ্মীরে পূজে । দেবী কৃপায় তাঁর সকল দুঃখ ঘোচে ।। রোগ ছাড়ি স্বামী পুনঃ সুস্থ হইলো । এই ভাবে তার সকল দুঃখ ঘুচিলো ।। আনন্দ দিনে এক সুন্দর পুত্র জন্মিলো । লক্ষ্মী কৃপায় ধন জন বৃদ্ধি পাইলো ।। এই ভাবে লক্ষ্মী ব্রত প্রচারে দেশ দেশান্তরে । সকলে শুনি লক্ষ্মী ব্রত করে ।। তাহা করি সকলের দুঃখ চলি যায় । কমলার কৃপা সকলের উপর বর্ষায় ।। একদিন লক্ষ্মী পূজোয় বসে বামাগণ । আসিলো এক বণিক তাঁহাদের সদন ।। বণিক কহে কোন দেবী কিবা পরিচয় । ইহারে করিলে পূজা কি ফল হয় ।। বামা গন কহে ইনি দেবী নারায়নী । ইহার কৃপাতে সুখে বাড়ে ব্রতিনী ।। গুরুবারে যে জন লক্ষ্মী পূজো করে । অবশ্যই পাইবে সুখ লক্ষ্মীর বরে ।। এই কথা শুনে হাসে বণিক মহাশয় । মানিনা এই সত্য তব কথায় ।। কপালে যদি না থাকে ধনের লিখন । কিরূপে দিবে লক্ষ্মী বর- ধন- জন ।। শুধু শুধু লক্ষ্মী পূজা করি কিবা হয় । বৃথা কাটাইতেছো লক্ষ্মীর পূজায় ।। গর্বে ভরা বাক্য লক্ষ্মী সইতে না পারে । ধীরে ধীরে দেবী তাহারে ছাড়ে ।। ঝড় উঠি ময়ূরপঙ্খি তার জলে ডোবে । ধন জন আদি সব গেলো চলি ভোগে ।। মড়কে রোগে তার ঘর হইলো ছারখার । ভিখারী হইয়া বণিক ঘোরে দ্বারে দ্বার ।। এই ভাবে বহু দেশ ঘোরে সদাগর । একদিন আসিলো অবন্তী নগর ।। সেই স্থানে ব্রত করে যতেক নারীগণে । বসি তারা মন দেয় লক্ষ্মীর ভজনে ।। এই দেখি বণিকের হইলো স্মরণ । এই স্থানে দেবীরে করিছে অবমানন ।। সেই পাপে সব ধ্বংস হইলো তাহার । ভূমিতে পড়ি সদাগর কান্দে বারবার ।। ক্ষমা করি দাও মাগো কহে সদাগর । এই স্থানে করেছি অনেক অহঙ্কার ।। ধনে গর্বে মত্ত হয়ে তোমাকে অবমাননা । সেই পাপে পাইলাম মাগো যতেক লাঞ্ছনা ।। ক্ষুধা জ্বালায় ঘুরি দেশ দেশান্তরে । যতেক আত্মীয় গেলা সবে আমায় ছেড়ে ।। এইভাবে সদাগর লক্ষ্মী স্তব করে । লক্ষ্মী দেবী করুণা করিল তাহারে ।। লক্ষ্মী কৃপায় বণিক সব ফিরি পায় । গৃহে ফিরি মন দেয় লক্ষ্মীর পূজায় ।। লক্ষ্মী কৃপায় সে সব ফিরি আসে। এই ভাবে ব্রত ছড়িলো দেশে দেশে ।। সবে মিলি শোনে লক্ষ্মীর ব্রতের কথন । লক্ষ্মীরে পূজে আছে যত জন ।। প্রতি গৃহে গৃহে লক্ষ্মী পূজো হয় । জগতজননীর কৃপা সকলের ওপর বর্ষায় ।। খাদ্য ধন জন বাড়ে লক্ষ্মীর কৃপায় । হরি হরি বল সবই তুলি হস্ত দ্বয় ।। যেই জন ভক্তি ভরে লক্ষ্মীরে পূজিবে । অবশ্যই তাহার সকল দুঃখ ঘুচি যাইবে ।। যে পড়ে ব্রত কথা আর যে করে শ্রবন । অবশ্য পাইবে সে লক্ষ্মী নারায়নের চরণ ।। ব্রত কথা না শুনিও কভু হেলা মনে । লক্ষ্মী কৃপায় অবশ্যই বাড়িবে ধনে জনে ।। জয় জয় ব্রহ্মময়ী, মা নারায়নী । তোমার কৃপায় শেষ করিনু পাঁচালী খানি ।। ( সমাপ্ত )

লক্ষ্মী দেবীর মাহাত্ম্য

লক্ষ্মী দেবী হলেন সুখ,শান্তি ও ধন সম্পদের দেবী।সাংসারিক অভাব অনটন করার জন্য এবং সুখ সমৃদ্ধি বৃদ্ধির জন্য প্রতি বৃহস্পতিবার দেবীর পূজা করা হয়। এছাড়া দূর্গা পূজার সময় মায়ের সাথে পূজিত হন। আজ আমরা দেবী মহালক্ষ্মীর সম্বন্ধে জানবো। লক্ষ্মী (সংস্কৃত: लक्ष्मी) তিনি হলেন ধনসম্পদ, আধ্যাত্মিক সম্পদ, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। তিনি বিষ্ণুর পত্নী। তাঁর অপর নাম মহালক্ষ্মী। জৈন স্মারকগুলিতেও লক্ষ্মীর ছবি দেখা যায়। লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা। লক্ষ্মী ছয়টি বিশেষ গুণের দেবী। তিনি বিষ্ণুর শক্তিরও উৎস। বিষ্ণু রাম ও কৃষ্ণ রূপে অবতার গ্রহণ করলে, লক্ষ্মী সীতা ও রাধা রূপে তাঁদের সঙ্গিনী হন।কৃষ্ণের দুই স্ত্রী রুক্মিনী ও সত্যভামাও লক্ষ্মীর অবতার রূপ। লক্ষ্মীর পূজা অধিকাংশ গৃহেই অনুষ্ঠিত হয়। দীপাবলি ও কোজাগরী পূর্ণিমার দিন তাঁর বিশেষ পূজা হয়। এটি কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা নামে খ্যাত। এছাড়া প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীপূজা করা হয়। ধ্যানমন্ত্র ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ।পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্।।গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বলঙ্কার-ভূষিতাম্।রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু।। অর্থঃ দক্ষিণহস্তে পাশ, অক্ষমালা এবং বামহস্তে পদ্ম ও অঙ্কুশধারিণী, পদ্মাসনে উপবিষ্টা, শ্রীরূপা, ত্রিলোকমাতা, গৌরবর্ণা, সুন্দরী, সর্বালঙ্কারভূষিতা, ব্যগ্রহস্তে স্বর্ণপদ্মধারিণী এবং দক্ষিণহস্তে বরদাত্রী দেবীকে ধ্যান করি। ব্রতকথাঃ ৷ লক্ষ্মী ব্রত কথা লক্ষ্মীরপাঁচালিতে লেখা আছে। একে লক্ষ্মীর পাঁচালি বলে। লক্ষ্মীর ব্রতকথাগুলির মধ্যে "বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা" সবচেয়ে জনপ্রিয়। বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা  প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর সাপ্তাহিক পূজা করা হয়। এই পূজা সাধারণত বাড়ির সধবা স্ত্রীলোকেরাই করে থাকেন। "বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা"-য় এই বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীব্রত ও পূজা প্রচলন সম্পর্কে যে লৌকিক গল্প রয়েছে, তা এইরকম: এক দোলপূর্ণিমার রাতে নারদ বৈকুণ্ঠেলক্ষ্মী ও নারায়ণের কাছে গিয়ে মর্ত্যের অধিবাসীদের নানা দুঃখকষ্টের কথা বললেন। লক্ষ্মী মানুষের নিজেদের কুকর্মের ফলকেই এই সব দুঃখের কারণ বলে চিহ্নিত করলেন।. কিন্তু নারদের অনুরোধে মানুষের দুঃখকষ্ট ঘোচাতে তিনি মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত প্রচার করতে এলেন। অবন্তী নগরে ধনেশ্বর নামে এক ধনী বণিক বাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেদের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া চলছিল। ধনেশ্বরের বিধবা পত্নী সেই ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে বনে আত্মহত্যা করতে এসেছিলেন। লক্ষ্মী তাঁকে লক্ষ্মীব্রত করার উপদেশ দিয়ে ফেরত পাঠালেন। ধনেশ্বরের স্ত্রী নিজের পুত্রবধূদের দিয়ে লক্ষ্মীব্রত করাতেই তাঁদের সংসারের সব দুঃখ ঘুচে গেল। ফলে লক্ষ্মীব্রতের কথা অবন্তী নগরে প্রচারিত হয়ে গেল। একদিন অবন্তীর সধবারা লক্ষ্মীপূজা করছেন, এমন সময় শ্রীনগরের এক যুবক বণিক এসে তাদের ব্রতকে ব্যঙ্গ করল। ফলে লক্ষ্মী তার উপর রাগান্বিত হলেন। সেও সমস্ত ধনসম্পত্তি হারিয়ে অবন্তী নগরে ভিক্ষা করতে লাগল। তারপর একদিন সধবাদের লক্ষ্মীপূজা করতে দেখে সে অনুতপ্ত হয়ে লক্ষ্মীর কাছে ক্ষমা চাইল। লক্ষ্মী তাকে ক্ষমা করে তার সব ধনসম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন। এইভাবে সমাজে লক্ষ্মীব্রত প্রচলিত হল। ৷৷৷৷।।।।।।।।।।জয় মা লক্ষ্মী।।।।।।।।।।।।

একজন হিন্দুর দৈনিক ধর্মীয় কার্যাবলী।

১. সকালে ঘুম থেকে উঠে পূর্বমুখী হয়ে মাটি স্পর্শ করে বলতে হবে _ ওঁ প্রিয়দত্তায়ৈ ভূম্যৈ নমঃ ২. ঘরের দরজা খুলে পূর্বমুখী হয়ে সূর্য প্রণাম মন্ত্র /ওঁ শ্রী সূর্যায় নমঃ ৩. স্নান করার সময় বলতে হবে _ ওঁ গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরি সরস্বতী নর্মদে সিন্ধু কাবেরি জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু পরে কৃতান্জলি হয়ে _ ওঁ কুরুক্ষেত্র গয় গঙ্গা প্রভাস পুস্করিণী চ । তীর্থান্যেতানি পুণ্যানি স্নানকালে ভবন্ত্বিহ । ৪ আসুন জেনে নেই একজন হিন্দুর দৈনিক ধর্মীয় কার্যাবলীঃ *** সকালে ঘুম থেকে উঠে পূর্বমুখী হয়ে মাটি স্পর্শ করে বলতে হবেঃ ওঁ প্রিয়দত্তায়ৈ ভূম্যৈ নমঃ ** ঘরের দরজা খুলে পূর্বমুখী হয়ে সূর্য প্রণাম মন্ত্রঃ ওঁ শ্রী সূর্যায় নমঃ । ** গৃহ প্রবেশ মন্ত্রঃ ওঁ শ্রী বাস্ত্তপুরুষায় নমঃ । ** ঘুমানোর আগেঃ ওঁ শ্রী পদ্মনাভায় নমঃ । **খাবার আগেঃ ওঁ শ্রী জনার্দ্দনায় নমঃ। **বিপদেঃ ওঁ শ্রী মধুসূদনায় নমঃ । ** মলমূত্র ত্যাগের আগেঃ আগ্গা কুরু বসুন্ধরা । **জন্ম সংবাদ শুনলেঃ আয়ুষ্মান ভব । **মৃত্যু সংবাদ শুনলেঃ দিব্যান্ লোকান্ স গচ্ছতু । ** হিন্দু ধর্মীয় সকল কাজ শুরু করার আগে ''ওঁ তৎ সৎ'' বলে শুরু করা উচিত ।

Monday, September 24, 2018

ভগবান শ্রী বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার নৃসিংহ অবতার।














নৃসিংহঃ (সংস্কৃত: नरसिंह, ) বিষ্ণুরচতুর্থ অবতার। পুরাণ, উপনিষদ ও অন্যান্য প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে তাঁর উল্লেখ রয়েছে। তিনি হিন্দুদের জনপ্রিয়তম দেবতাদের অন্যতম। সাধারণত দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের অন্যতম প্রতীক তিনি ৷ প্রাচীন মহাকাব্য, মূর্তিতত্ত্ব, মন্দির ও উৎসব ইত্যাদির তথ্যপ্রমাণ থেকে জানা যায় এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে তাঁর পূজা প্রচলিত রয়েছে।নৃসিংহকে শৌর্যের মূর্তিস্বরূপ এবং তাঁর মন্ত্র শত্রুনিধন ও অমঙ্গল দূরীকরণে বিশেষ ফলপ্রসূ বলে মনে করা হয়; তাই অতীতে শাসক ও যোদ্ধারা নৃসিংহের পূজা করতেন।

নৃসিংহ অর্ধ-মনুষ্য অর্ধ-সিংহ আকারবিশিষ্ট। তাঁর দেহ মনুষ্যাকার, কিন্তু সিংহের ন্যায় মস্তক ও নখরযুক্ত।মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী নৃসিংহ অষ্টভূজ হলেও, অগ্নিপুরাণ অনুযায়ী তিনি চতুর্ভূজ। একাধিক বৈষ্ণবসম্প্রদায়ে তাঁর পূজা প্রচলিত। দক্ষিণ ভারতে নৃসিংহ পূজার বিশেষ প্রচলন
দেখা যায়। হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নৃসিংহ ‘মহারক্ষক’; তিনি ভক্তকে তার প্রয়োজনের সময় সর্বদা রক্ষা করে থাকেন।

শাস্ত্রোল্লেখ

একাধিক পুরাণ গ্রন্থে নৃসিংহের উল্লেখ পাওয়া যায়। পুরাণে নৃসিংহ-সংক্রান্ত মূল উপাখ্যানটির সতেরোটি পাঠান্তর বর্তমান। কয়েকটি কাহিনি অন্যান্য কাহিনিগুলির চেয়ে একটু বিস্তারিত। নৃসিংহ অবতারের বর্ণনা রয়েছে ভাগবত পুরাণ (সপ্তম স্কন্দ), অগ্নিপুরাণ (৪।২-৩), ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ (২।৫।৩-২৯), বায়ুপুরাণ (৬৭।৬১-৬৬), হরিবংশ (৪১ এবং ৩।৪১-৪৭), ব্রহ্মাপুরাণ (২১৩।৪৪-৭৯), বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ (১।৫৪), কূর্মপুরাণ (১।১৫।১৮-৭২), মৎস্যপুরাণ(১৬১-১৬৩), পদ্মাপুরাণ (উত্তরখণ্ড, ৫।৪২), শিবপুরাণ(২।৪।৪৩ ও ৩।১০-১২), লিঙ্গপুরাণ (১।৯৫-৯৬), স্কন্দপুরাণ ৭ (২।১৮।৬০-১৩০) ও বিষ্ণুপুরাণ (১।১৬-২০) গ্রন্থে। মহাভারত-এও (৩।২৭২।৫৬-৬০) নৃসিংহ অবতারের একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা রয়েছে। এছাড়া একটি প্রাচীন বৈষ্ণব তাপনী উপনিষদ(নরসিংহ তাপনী উপনিষদ) তাঁর নামে উল্লিখিত হয়েছে।

বৈদিক উল্লেখ

ঋগ্বেদে একটি শ্লোকাংশে একটি রূপকল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই রূপকল্পটি নৃসিংহরূপী বিষ্ণুর রূপকল্প বলে অনুমিত হয়ে থাকে। উক্ত শ্লোকে বলা হয়েছে "বন্য জন্তুর ন্যায়, ভয়ংকর, বিধ্বংসী ও পর্বতচারী" রূপে বিষ্ণুর গুণ কেবল তাঁর অবতারে দৃষ্ট হয় (ঋগ্বেদ ১।১৫৪।২ক)। ঋগ্বেদের অষ্টম মণ্ডলে (১৪।১৩) বর্ণিত নামুচির উপাখ্যানে নৃসিংহের ছায়া লক্ষিত হয়: "হে ইন্দ্র, জলের বুদ্বুদের দ্বারা তুমি নামুচির মস্তক ছিন্ন করলে এবং সকল প্রতিকূল শক্তিগুলিকে নিমজ্জিত করলে।" মনে করা হয় এই ক্ষুদ্র উল্লেখটি থেকে নৃসিংহের পূর্ণ কাহিনিটি বিকাশ লাভ করেছে।

নৃসিংহ ও প্রহ্লাদ





ভাগবত পুরাণ-এ বর্ণিত নৃসিংহের কাহিনিটি নিম্নরূপ:

নৃসিংহের পূর্ববর্তী অবতার বরাহ হিরণ্যাক্ষ নামে এক রাক্ষসকে বধ করেন। হিরণ্যাক্ষের ভাই হিরণ্যকশিপুএই কারণে প্রবল বিষ্ণুবিদ্বেষী হয়ে ওঠেন। দাদার হত্যার প্রতিশোধ মানসে তিনি বিষ্ণুকে হত্যা করার পথ খুঁজতে থাকেন। তিনি মনে করেন, সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এই জাতীয় প্রবল ক্ষমতা প্রদানে সক্ষম। তিনি বহু বছর ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা করেন। ব্রহ্মাও হিরণ্যকশিপুর তপস্যায় সন্তুষ্ট হন। তিনি হিরণ্যকশিপুর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁকে বর দিতে চান। হিরণ্যকশিপু বলেন:

হে প্রভু, হে শ্রেষ্ঠ বরদাতা, আপনি যদি আমাকে সত্যই বর দিতে চান, তবে এমন বর দিন যে বরে আপনার সৃষ্ট কোনো জীবের হস্তে আমার মৃত্যু ঘটবে না।

আমাকে এমন বর দিন যে বরে আমার বাসস্থানের অন্দরে বা বাহিরে আমার মৃত্যু ঘটবে না; দিবসে বা রাত্রিতে, ভূমিতে বা আকাশে আমার মৃত্যু হবে না। আমাকে এমন বর দিন যে বরে শস্ত্রাঘাতে, মনুষ্য বা পশুর হাতে আমার মৃত্যু হবে না।

আমাকে এমন বর দিন যে বরে কোনো জীবিত বা মৃত সত্তার হাতে আমার মৃত্যু হবে না; কোনো উপদেবতা, দৈত্য বা পাতালের মহানাগ আমাকে হত্যা করতে পারবে না; যুদ্ধক্ষেত্রে আপনাকে কেউই হত্যা করতে পারে না; তাই আপনার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। আমাকেও বর দিন যাতে আমারও কোনো প্রতিযোগী না থাকে। এমন বর দিন যাতে সকল জীবসত্তা ও প্রভুত্বকারী দেবতার উপর আমার একাধিপত্য স্থাপিত হয় এবং আমাকে সেই পদমর্যাদার উপযুক্ত সকল গৌরব প্রদান করুন। এছাড়া আমাকে তপস্যা ও যোগসাধনার প্রাপ্তব্য সকল সিদ্ধাই প্রদান করুন, যা কোনোদিনও আমাকে ত্যাগ করবে না।


নৃসিংহ মূর্তি

হিরণ্যকশিপু যখন মন্দার পর্বতে তপস্যা করছিলেন, তখন ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবগণ তাঁর প্রাসাদ আক্রমণ করেন। দেবর্ষি নারদ হিরণ্যকশিপুর স্ত্রী কায়াদুকে রক্ষা করেন। দেবর্ষি দেবগণের নিকট কায়াদুকে ‘পাপহীনা’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। নারদ কায়াদুকে নিজ আশ্রমে নিয়ে যান। সেখানে কায়াদু প্রহ্লাদ নামে একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। নারদ প্রহ্লাদকে শিক্ষিত করে তোলেন। নারদের প্রভাবে প্রহ্লাদ হয়ে ওঠেন পরম বিষ্ণুভক্ত। এতে তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন।

ক্রমে প্রহ্লাদের বিষ্ণুভক্তিতে হিরণ্যকশিপু এতটাই ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত হন যে তিনি নিজ পুত্রকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যতবারই তিনি বালক প্রহ্লাদকে বধ করতে যান, ততবারই বিষ্ণুর মায়াবলে প্রহ্লাদের প্রাণ রক্ষা পায়। হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলেন তাঁকে ত্রিভুবনের অধিপতি রূপে স্বীকার করে নিতে। প্রহ্লাদ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন একমাত্র বিষ্ণুই এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ প্রভু। ক্রুদ্ধ হিরণ্যকশিপু তখন একটি স্তম্ভ দেখিয়ে প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করেন যে ‘তার বিষ্ণু’ সেখানেও আছেন কিনা:

"ওরে হতভাগা প্রহ্লাদ, তুই সব সময়ই আমার থেকেও মহৎ এক পরম সত্তার কথা বলিস। এমন এক সত্তা যা সর্বত্র অধিষ্ঠিত, যা সকলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং যা সর্বত্রব্যাপী। কিন্তু সে কোথায়? সে যদি সর্বত্র থাকে তবে আমার সম্মুখের এই স্তম্ভটিতে কেন নেই?"




প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, তিনি [এই স্তম্ভে] ছিলেন, আছে ও থাকবেন। উপাখ্যানের অন্য একটি পাঠান্তর অনুযায়ী, প্রহ্লাদ বলেছিলেন, তিনি এই স্তম্ভে আছেন, এমনকি ক্ষুদ্রতম যষ্টিটিতেও আছেন। হিরণ্যকশিপু ক্রোধ সংবরণ করতে না পেরে গদার আঘাতে স্তম্ভটি ভেঙে ফেলেন। তখনই সেই ভগ্ন স্তম্ভ থেকে প্রহ্লাদের সাহায্যার্থে নৃসিংহের মূর্তিতে আবির্ভূত হন বিষ্ণু। ব্রহ্মার বর যাতে বিফল না হয়, অথচ হিরণ্যকশিপুকেও হত্যা করা যায়, সেই কারণেই বিষ্ণু নরসিংহের বেশ ধারণ করেন: হিরণ্যকশিপু দেবতা, মানব বা পশুর মধ্য নন, তাই নৃসিংহ পরিপূর্ণ দেবতা, মানব বা পশু নন; হিরণ্যকশিপুকে দিবসে বা রাত্রিতে বধ করা যাবে না, তাই নৃসিংহ দিন ও রাত্রির সন্ধিস্থল গোধূলি সময়ে তাঁকে বধ করেন; হিরণ্যকশিপু ভূমিতে বা আকাশে কোনো শস্ত্রাঘাতে বধ্য নন, তাই নৃসিংহ তাঁকে নিজ জঙ্ঘার উপর স্থাপন করে নখরাঘাতে হত্যা করেন; হিরণ্যকশিপু নিজ গৃহ বা গৃহের বাইরে বধ্য ছিলেন না, তাই নৃসিংহ তাঁকে বধ করেন তাঁরই গৃহদ্বারে।

কূর্মপুরাণ-এর বর্ণনা অনুসারে, এরপর পুরুষ ও দৈত্যদের মধ্যে এক প্রবল সংগ্রাম শুরু হয়। এই যুদ্ধে তিনি পাশুপত নামে এক মহাস্ত্রকে প্রতিহত করেন। পরে প্রহ্লাদের ভাই অনুহ্রদের নেতৃত্বাধীন দৈত্যবাহিনীকে নৃসিংহ অবতারের দেহ হতে নির্গত এক মহাসিংহ যমালয়ে প্রেরণ করেন। মৎস্যপুরাণ (১৭৯) গ্রন্থেও নৃসিংহ অবতারের বর্ণনার পর এই ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে।

ভাগবত পুরাণ-এ আরও বলা হয়েছে: হিরণ্যকশিপুকে বধ করার পর সকল দেবতাই নৃসিংহদেবের ক্রোধ নিবারণে ব্যর্থ হন। বিফল হন স্বয়ং শিবও। সকল দেবগণ তখন তাঁর পত্নী লক্ষ্মীকে ডাকেন; কিন্তু লক্ষ্মীও স্বামীর ক্রোধ নিবারণে অক্ষম হন। তখন ব্রহ্মার অনুরোধে প্রহ্লাদ এগিয়ে আসেন। ভক্ত প্রহ্লাদের স্তবগানে অবশেষে নৃসিংহদেব শান্ত হন।নৃসিংহদেব "প্রহ্লাদকে কোলে লইয়া গা চাটিতে লাগিলেন।" প্রত্যাবর্তনের পূর্বে নৃসিংহদেব প্রহ্লাদকে রাজা করে দেন।



শিবপুরাণ গ্রন্থে নৃসিংহ উপাখ্যানের একটি শৈবপাঠান্তর বর্ণিত হয়েছে, যা প্রথাগত কাহিনিটির থেকে একটু ভিন্ন: নৃসিংহকে শান্ত করতে শিব প্রথমে বীরভদ্রকে প্রেরণ করেন। কিন্তু বীরভদ্র ব্যর্থ হলে শিব স্বয়ং মনুষ্য-সিংহ-পক্ষী রূপী শরভের রূপ ধারণ করেন। এই কাহিনির শেষভাগে বলা হয়েছে, শরভ কর্তৃক বদ্ধ হয়ে বিষ্ণু শিবের ভক্তে পরিণত হন। লিঙ্গপুরাণ গ্রন্থেও শরভের কাহিনি রয়েছে। যদিও বিজয়েন্দ্র তীর্থ প্রমুখ বৈষ্ণব দ্বৈতবাদী পণ্ডিতগণ সাত্ত্বিক পুরাণ ও শ্রুতি শাস্ত্রের ভিত্তিতে নৃসিংহের উপাখ্যানটির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতে বিতর্কের অবকাশ রেখেছেন।

এই উপাখ্যান অনুসারে এবং ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, নৃসিংহদেব তাঁর সত্য ভক্তদের চরমতম বিপদের সময় রক্ষা করেন। একটি কিংবদন্তি অনুসারে, এক কাপালিক দেবী কালীর নিকট আদি শংকরকে বলি দিতে গেলে নৃসিংহদেব তাঁকে রক্ষা করেছিলেন; এরপরই আদি শংকর তাঁর প্রসিদ্ধ লক্ষ্মী-নরসিংহ স্তোত্রটি রচনা করেন।
তথ্যসূত্রঃঃ Wikipedia

Tuesday, September 18, 2018

অবতার কি এবং কেন পৃথিবীতে আবির্ভাব হয়েছিল ও অবতারদের বর্ণনা?

পৃথিবী সৃষ্টির সময় বিধাতা মানুষের বসবাস উপযোগী করার জন্য আর অনেক কিছু সৃষ্টি করেন।যেমন আকাশ মন্ডলে সৃষ্টি করেন চন্দ্র,সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, তারা প্রভৃতি।তেমনি পৃথিবী তে সৃষ্টি করেন নদী,সাগর,পাহাড়,পর্বত,গাছ, পশুপাখি, আর অনেক কিছু।আবার এই প্রাকৃতিক সৃষ্টি কে নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে বেধে দিয়েছেন।তদ্রূপ মানুষ সৃষ্টির সময় মানুষকেও কিছু বিধিবিধান দিয়েছেন। ন্যায় -অন্যায়,পাপ পূণ্য বিচার করার বোধশক্তি একমাত্র মানুষের আছ।এজন্য মানুষকে সৃষ্টির সেরাজীব বলা হয়।কিন্তু কিছু মানুষ বা অসুর ঈশ্বরের আরাধনা করে বর লাভ করেন।তারা বিধাতার কাছে অমরত্ব, অজেয়,পাতাল, স্বর্গ, ত্রিভূবনে, তাদেরকে যেন কোন দেবতা হত্যা বা পরাজয় না করতে পারে।বিধাতা বা দেবতারা তাদের অঙ্গীকার অনুযায়ী বর দেন এবং বিভিন্ন শর্ত দেন।শর্ত অনুযায়ী তাদের কিভাবে মৃত্যু হবে তা বলে দেওয়া হয়।বরপাপ্ত হয়ে তারা স্বর্গ দখল করে নেন।তারা পৃথিবীতে পাপের রাজ্য বিস্তার করেন।যখন তারা পাপে পরিপূর্ণ হয়ে যায়,তখন সেই শর্ত অনুযায়ী ভগবান শ্রী বিষ্ণু বিশেষ রূপে পৃথিবীতে আসেন এবং অসুর ও পাপী মানুষদের বধ করেন।তাহলে বলা যায় পৃথিবীকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বা পাপী মানুষ ও অসুরদের বধ করার জন্য ভগবান শ্রী বিষ্ণু যে বিশেষ রূপে পৃথিবীতে আসেন তাকেই অবতার বলা হয়।
(নিজেস্ব মতবাদ)

এর আগের পোস্টে আমি ভগবান শ্রী বিষ্ণুর দুজন অবতার সম্বন্ধে বলে ছিলাম। আজ আমি অন্য অবতারদের সম্বন্ধে বলব।






                               বরাহ অবতার
বরাহ ঃবরাহ হলেন ভগবান শ্রী বিষ্ণুর ৩য় অবতার। এই অবতারে ভগবান শ্রী বিষ্ণু বন্য শূকরের রূপ ধারণ করেছিলেন। পুরাণ মতে, তিনি হিরণ্যাক্ষ নামক রাক্ষসের হাত থেকে ভূদেবী পৃথিবীকে উদ্ধার করেন। হিরণ্যাক্ষ পৃথিবীকে মহাজাগতিক সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে রেখেছিলেন। বিষ্ণু বরাহ-এর বেশ ধারণ করে এক হাজার বছর ধরে হিরণ্যাক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাঁকে পরাজিত ও নিহত করেন। তারপর পৃথিবীকে মহাজাগতিক সমুদ্রের তলা থেকে উদ্ধার করেনা

বরাহ রূপটিতে তাঁর চারটি হাত; চার হাতে শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম; এবং বরাহদন্তে ধরা থাকে পৃথিবী। বরাহ অবতার প্রলয়ের পর পৃথিবীর নবজন্ম ও নতুন কল্পপ্রতিষ্ঠা করেন। 
নৃসিংহ
অবতারের কাহিনী পরবর্তী পোস্টেে দিব।
সবাইকে নমস্কার
  




Friday, September 14, 2018

ভগবান শ্রী বিষ্ণু এবং দশ অবতারের সম্বন্ধে জানুন।


আমরা যারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তারা কম বেশি সবাই ভগবান শ্রী বিষ্ণু এবং তার দশ অবতার সম্বন্ধে জানি।তিনি যুগে যুগে পৃথিবীতে অবতার রূপে এসে পাপী অসুরদের দমন করেন।তিনি চারটি যুগে নয়টি অবতার রূপে এসেছেন।কলিযুগের শেষে তিনি কল্কি অবতার রূপে পৃথিবীতে আসবেন।সকল পাপীদের ধংস করে সত্য যুগের সূচনা করবেন।





বিষ্ণু ঃ (সংস্কৃত: विष्णु)  শ্রী বিষ্ণু ঈশ্বরের পাঁচটি প্রধান রূপের অন্যতম। আবার তৈত্তিরীয় শাখা ও ভগবদ্গীতা আদি শ্রুতিশাস্ত্রে তাঁকে সর্বোচ্চ ঈশ্বরের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।
ভগবান শ্রী  বিষ্ণু হলেনপরমাত্মা ও পরমেশ্বর । তিনি হলেন সর্ব জীব ও সর্ববস্তুতে পরিব্যাপ্ত সত্ত্বা; অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তথা অনাদি অনন্ত সময়ের প্রভু; সকল অস্তিত্বের স্রষ্টা ও ধ্বংসকারী; বিশ্বচরাচরের ধারক, পোষক ও শাসক এবং বিশ্বের সকল বস্তুর উৎসপুরুষ।

পুরাণ অনুসারে, বিষ্ণুর গাত্রবর্ণ ঘন মেঘের ন্যায় নীল (ঘনশ্যাম); তিনি চতুর্ভূজ এবং শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী। ভগবদ্গীতা গ্রন্থে বিষ্ণুর বিশ্বরূপেরও বর্ণনা আছে।

বিষ্ণু সহস্রনামে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার উক্তিতে বিষ্ণুকে "সহস্রকোটি যুগ ধারিনে" বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর অর্থ, বিষ্ণুর অবতারগণ সকল যুগেই জন্মগ্রহণ করে থাকেন। ভগবদ্গীতা অনুসারে, ধর্মের পালনএবং দুষ্টের দমন ও পাপীর ত্রাণের জন্য বিষ্ণু অবতার গ্রহণ করেন। হিন্দু ধর্মে বিষ্ণুকে বিষ্ণু বা রাম, কৃষ্ণ প্রমুখ অবতারের রূপে পূজা করা হয়।

হিন্দুধর্মের ত্রিমূর্তি ধারণায় ব্রহ্মাকেবিশ্বচরাচরের সৃষ্টির প্রতীক, বিষ্ণুকে স্থিতির প্রতীক ও শিবকে ধ্বংসের প্রতীক রূপে পূজা করা হয়। ভাগবত পুরাণ মতে, ত্রিমূর্তির এই তিন দেবতার মধ্যে বিষ্ণুর পূজাই সর্বাপেক্ষা অধিক ফলপ্রদ।বিষ্ণু পুরাণ অনুসারে ভগবান বিষ্ণুই সর্ব‌চ্চো ঈশ্বর । ভগবান বিষ্ণু থেকেই ব্রহ্মা এবং শিবের উৎপত্তি ।

==ধ্যানমন্ত্র==ওমঃ নমোঃ ব্রাক্ষন্য দেবায় গোঃ ব্রাক্ষন্য হিতায়ঃ চঃ জগঃধ্বিতায় কৃষ্ণাাায়ঃ নমঃ নমঃ

দশাবতার

বিষ্ণু নয়বার পৃথিবী উদ্ধারের জন্য আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং কলিযুগে কল্কি অবতার হয়ে আসবেন বলে বিশ্বাস করা হয়। এই দশটি অবতার যথাক্রমে মৎস্য, কূর্ম , বরাহ, নৃসিংহ, বামন, পরশুরাম, রাম, কৃষ্ণ, বুদ্ধ এবং কল্কি।

নিম্নে দশ অবতারের বর্ণনা দেওয়াা হল।

মৎস্যঃ(সংস্কৃত: मत्स्य,) হল দেবতা বিষ্ণুর মাছরূপী অবতার, যা কূর্ম-এর পূর্ববর্তী অবতার। সাধারণতঃ এই অবতারটিকে বিষ্ণুর প্রথম অবতার হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। পুরাণে বর্ণিত হয়েছে, মৎস্য পৃথিবীর প্রথম মানুষ মনুকে এক বিরাট বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন। মৎস্য অবতারের  শরীরের উর্ধাংশ পুরুষ মানুষের ও নিম্নাংশ মাছ আকৃতির।

ভগবান শ্রী বিষ্ণু মৎস্য অবতার রূপে মনুকে বিধ্বংসী বন্যা সম্পর্কে পূর্বসতর্ক করে এবং তাকে পৃথিবীর সমস্ত শস্য ও জীবসমূহকে একটি নৌকায় জড়ো করতে বলে। বন্যার ক্ষণ উপস্থিত হলে মৎস্য মনু, সপ্তর্ষি ও জিনিসপত্র সমেত নৌকাটিকে টেনে নিয়ে রক্ষা করে। কিন্তু কাহিনীর পরবর্তী সংস্করণে দেখানো হয়েছে, পবিত্র বেদগুলি একটি অসুর চুরি করে এবং মৎস্য ঐ অসুরকে বধ করে বেদগুলি উদ্ধার করেন।

কাহিনী

মৎস্য পুরাণ অনুসারে, প্রাগৈতিহাসিক দ্রাবিড় রাজ্যের বিষ্ণুভক্ত রাজা সত্যব্রত (যিনি পরে মনু নামে পরিচিত হন) একদিন নদীর জলে হাত ধুচ্ছিলেন। এমন সময় একটি ছোটো মাছ তাঁর হাতে চলে আসে এবং তাঁর কাছে প্রাণভিক্ষা চায়। তিনি মাছটিকে একটি পাত্রে রাখেন। কিন্তু মাছটি ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। তিনি সেটিকে প্রথমে একটি পুষ্করিণীতে, পরে নদীতে এবং শেষে সমুদ্রে ছেড়ে দেন। কিন্তু কোনো ফল হয় না। সেটি এতটাই বৃদ্ধি পায় যে সকল আধারই পূর্ণ হয়ে যায়। শেষে মাছটি বিষ্ণুর রূপে আত্মপ্রকাশ করে সত্যব্রতকে জানান যে সাত দিনের মধ্যে প্রলয় সংঘটিত হবে এবং সকল জীবের বিনাশ ঘটবে। তাই সত্যব্রতকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে সকল প্রকার ঔষধি, সকল প্রকার বীজ, সপ্তর্ষি, বাসুকি নাগ ও অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গে নিতে।
প্রলয় সংঘটিত হলে মৎস্যরূপী ভগবান শ্রী বিষ্ণু পূর্বপ্রতিশ্রুতি অনুসারে পুনরায় আবির্ভূত হন। তিনি সত্যব্রতকে একটি নৌকায় আরোহণ করতে বলেন এবং তাঁর শিঙে বাসুকি নাগকে নৌকার কাছি হিসেবে বাঁধতে বলেন।এভাবে তিনি সৃষ্টিকে ধংসের হাত থেকে রক্ষা করলেন।
  কূর্ম অবতারঃকূর্ম হলেন ভগবান বিষ্ণুেের  দ্বিতীয় অবতার । এর পূর্বের অবতার মৎস্য  এবং পরের অবতার বরাহ। মৎস অবতারের মত এটিও সত্যযুগের অবতার । কূর্ম অবতারের জন্য উৎসর্গীকৃত মন্দির হল   হল অন্ধপদেশলার কুর্মাই মন্দির ও শ্রীকুর্মাম মন্দির ।
একদা ঋষি দেবরাজ ঔ  দিব্য পুষ্পমালা উপহার দিয়েছিলেন । ইন্দ্র সেই মালা সাদরে গ্রহণ করে তাঁর বাহন হমাথায় রাখেন। কিন্তু ঐরাবত সেই মালা তার শুঁড়ে জড়িয়ে মাটিতে ফেলে নষ্ট করে দেয়। এতে ঋষি ক্রুদ্ধ হয়ে ইন্দ্রকে শ্রীহীন হবার অভিশাপ দেন। ব্রহ্মা তখন পুনরায় অমৃতপ্রাপ্তির জন্য অসুরদের সাহায্যে সমুদ্রমন্থনের পরামর্শ দেন । মন্থন কালে মন্দর পর্বত সমুদ্রে ঢুকে যাচ্ছিল তাই তখন ভগবান বিষ্ণু কূর্ম রূপ ধারণ করে মন্দর পর্বতকে তাঁর পৃষ্ঠে ধারণ করেন। এভাবে পুনরায় অমৃত প্রাপ্তি হয়।
পরবর্তী   poste   বাকি আট অবতারের বর্ননা দিব 

Monday, September 10, 2018

নরকের বর্ণনা

নরক (সংস্কৃত: नरक) হচ্ছে হিন্দুধর্মে  মৃত্যুর পর পাপীরা যেখানে শাস্তি ভোগ করে। ইহা মৃত্যু দেবতা যমরাজেরবাসস্থান। বর্ণনা করা হয় যে এটি মহাবিশ্বের দক্ষিণে এবং পৃথিবীর নীচে অবস্থিত। 

বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন নামের ও সংখ্যার পাশাপাশি কোন্ প্রকারের পাপীকে কোন্ নরকে পাঠানো হবে তার ভিন্নতা পাওয়া যায়; তবে অনেক ধর্মগ্রন্থে ২৮ টি নরকের বর্ননা পাওয়া যায়। মৃত্যুর পর, যমদূত নামক যমরাজের দূতেরা, সমস্ত জাতিকে যমরাজের রাজসভায় নিয়ে আসে, যেখানে তাদের পাপ-পুণ্যের হিসাব করা হয় এবং দণ্ডাদেশ দেয়া হয় যে পুণ্যকারীদের স্বর্গে এবং পাপীদের যেকোন একটি নরকে পাঠানো হয়। স্বর্গে বা নরকে তাদের অবস্থান সাময়িক হয়ে থাকে। শাস্তি ভোগের পর, তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী নিম্নতর বা উচ্চতর প্রাণী হিসেবে তাদের পুনর্জন্ম হয়। কিছু কিছু গ্রন্থে, নরককে অন্ধকারের সবচেয়ে নিচের স্তর বলে ব্যাখ্যা করা হয় যেখানে আত্মাদের অনন্তকালের জন্য আটক করা হয় এবং পুনর্জন্ম থেকে বঞ্চিত করা হয়।

অবস্থান

ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে নরক পৃথিবীর নিচে: পাতালের সাতটি স্তর এবং মহাবিশ্বের তল গর্ভোদক সাগরের মাঝামাঝি অবস্থিত। এটি মহাবিশ্বের দক্ষিণে অবস্থিত। পিতৃলোক, যেখানে অগ্নিকুভের নেতৃত্বে মৃত পূর্বপুরুষ (পিতৃগণ) বাস করে, এই অঞ্চলে অবস্থিত। নরকরাজ যম তার সহকারীদের সাথে এইখানে বসবাস করেন। দেবীভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে যে নরক মহাবিশ্বের দক্ষিণে, পৃথিবীর নিচে কিন্তু পাতালের উপরে অবস্থিত। বিষ্ণু পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে যে, নরক মহাবিশ্বের নীচে অবস্থিত মহাজাগতিক সাগরের নীচে অবস্থিত। বিভিন্ন হিন্দু মহাকাব্যও একমত যে নরক দক্ষিণ দিকে অবস্থিত, যেদিকে মৃতদের সাথে সম্পর্কিত যমরাজ শাসন করেন। পিতৃলোককে যমের রাজধানী হিসেবে গণ্য করা হয়, যেখানে যম তাঁর ন্যায়বিচার প্রদান করেন।